হাতের তিন নাম্বার আঙুলের নখটি বিপু বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কামড়ে ছাটাই করছে। কিন্তু ছাটাই করা শেষ হতে না হতেই মনে পড়লো এই নিয়ে তিন তিনটি নখ কামড়ে ছেটে ফেলছে। কিন্তু এগুলো এখন রাখবে কোথায়...! নিচেও ফেলা যাবে না মার্বেলের ঝকঝকে মেঝে পিন পড়লেও দেখা যাবে। সাত-পাঁচ ভেবে সে নখগুলো পকেটে পুরে দিলো। আসলাম সাহেবের ড্রইংরুমের ঘড়িতে রাত ৮টা বেজে ৫৫ মিনিট। বিপু সেই মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে ২৫ মিনিট হলো। তার মাঝে কাজের লোক এসে এক কাপ ঠান্ডা চা আর ৪ পিস ড্রাই কেক দিয়ে গেছে। এরমধ্যেই তিনটি সাবাড় করে একটি পিরিচে জমা রেখে দিয়েছে। বিপু আসলাম সাহেবের ছেলের গৃহশিক্ষক।
ঈদের তিনদিন বাকি। কাল থেকে বিপুর ঈদের ছুটি শুরু হবে। আসলাম সাহেবের স্ত্রী বিপুকে টিউশন শেষে অপেক্ষা করতে বলেছিলো। অবশেষে রাত ৯টায় আসলাম সাহেবের স্ত্রীর আগমন, হাতে একটা খাম, খামভর্তি চিকন অঙ্কের কিছু টাকা। বিপুর ইচ্ছে হলো খামটা খামচি মেরে ছিঁড়ে দেখতে ২৫০০ না ৩০০০ টাকা। কিন্তু সৌজন্যতার খাতিরে তা না করেই বিপু রওনা হলো বাসার দিকে। অবশেষে খাম খুলে দেখলো বোনাস ৫০০ টাকাসহ ৩০০০ টাকাই আছে। তিনটি টিউশন মিলিয়ে এ মাসের ইনকাম ছয় হাজার টাকা। সারা বছর ধরে জমানো আরো আছে চার হাজার টাকা। রাতের ঘুমোতে যাওয়ার আগেই এবার ঈদের কেনা-কাটার ব্যাপারে একটা হিসাব কষে নিলো সে। কাল বাড়িতে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিবে, মা, ছোট বোন আর বাবার জন্য। আরো কিছু মিলিয়ে উনারা উনাদের মতো করে কিছু কিনে নিবে।
আর বাকি পাঁচ হাজার বিপুর নিজের জন্য। ঘুম থেকে উঠেই বিপু রওনা হলো বিকাশের দোকানে। সেখানে মাকে টাকা পাঠিয়ে সোজা চললো রেলস্টেশনের পাশে। তার ও তার বন্ধুরা মিলে গড়া ছিন্নমূল শিশুদের জন্য একটি ছোট স্কুল আছে সেখানে। আজকে অবশ্য তার বন্ধু মুহিতের ক্লাস নেয়ার পালা। ক্লাস শুরুর আগেই মুহিতের সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সারতে হবে। মুহিত রীতিমত ৯টায় স্কুলে হাজির। পথিমধ্যে বিপুর স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলো, ছেঁড়া স্যান্ডেল নিয়ে কোনো মতে পরিচিত এক মুচির দোকানে গেলো। মুচির দোকানে পৌঁছে স্যান্ডেল সেলাই করিয়ে নিলো। মুচিকে টাকা দেওয়ার সময় মুচি ৮ দিনের চাঁদের মতো এক গাল হেসে বললো, মামা এই নিয়ে এগারো বার। ঈদে এক জোড়া নতুন জুতা নিয়েন। বিপু মুচকি হেসে শুধু বললো, জ্বি মামা দেখি।
স্কুলে পৌঁছে মুহিতকে তার পরিকল্পনার কথা বলে বাসায় চলে আসলো। পরের দিন বিপু আর মুহিত এক সাথে শপিংয়ে বের হলো। মোটামুটি সব শপিং সেরে বিপু মুহিতকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে, বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ম্যাসের দিকে রওনা হলো। ম্যাচে পৌঁছে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো বিপু। ঈদের দিন সকাল বেলা মা-র ডাকা-ডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে বিপুর, ঘুম থেকে উঠেই গোসল সেরে ঈদের নামাজের জন্য পাঞ্জাবি বের করে দেখে পাঞ্জাবি আয়রন করা হয়নি।
ঘরে আয়রনের ব্যবস্থাও নেই। ছোট বোন এসে জিজ্ঞাস করলো,
-ভাইয়া তুই কি কিনছিস্ দেখি?
-বিপু বিপুল উৎসাহ নিয়ে তার মোচড়ানো পাঞ্জাবি দেখিয়ে বললো, 'সুন্দর হইছে না?'
ছোট বোন কতোক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ভ্রু কুঁচকে বললো,
-'এটা না তোর গত ঈদের পাঞ্জাবি?
' বিপু বললো,
- 'হ্যাঁ, গত ঈদের তো কি হইছে?
নতুন তো। আয়রন করা হয় নাই আর কি, ভুলে গেছিলাম।'
-কই নতুন দেখলি এটা তো রঙ ফিকে হয়ে গেছে। তার উপর মোচড়ানো।
-আরে যাহ! সেদিন কিনছি। সে কোনো ব্যাপার না। ছোট বোন 'তোর মাথা' বলে ভেঙচি কেটে চলে গেলো।
বেচারা মনে কষ্ট পেয়েছে ভেবে বিপুরও কিছুটা মন খারাপ হলো। যাই হোক বিপু মাকে সালাম করে ঈদের নামাজে চলে গেলো, মা-র বকুনি এড়ানোর জন্য। নামাজ পড়ে ঈদগাহ থেকে বের হয়েই বিপু মৌমিতাকে ফোন দিলো। ঈদ শুভেচ্ছার পরেই মৌমিতা বিপুকে ছবি পাঠাতে বললো। ম্যাসেঞ্জারে ছবি পাঠাতেই মৌমিতা জিজ্ঞাস করলো,
-তুমি না বলেছো তুমি পাঞ্জাবি কিনেছো, এটা যে আগের পাঞ্জাবি?
বিপু : হ্যাঁ কিনেছিতো, কিন্তু আমার জন্য না তো।
মৌমিতা : তো কার জন্য?
বিপু : ওই যে সবার জন্য।
মৌমিতা : তুমি কিছু কিনোনি?
বিপু : না।
মৌমিতা রাগ করে কল কেটে, সেল বন্ধ করে দিলো। বিপু ঈদগাহ থেকে বাড়ি না ফিরেই রওনা হলো শহরের দিকে। সারাদিন মুহিত আর বিপু সারা শহর ঘুরলো এক দল বাচ্চাদের সাথে। বিকেলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
সেদিন সন্ধ্যার কথা,
সারাদিন বিপুর ফেসবুক নিউজ ফিডে শো করেছিলো বন্ধুদের রঙ-বেরঙ এর ছবি। হ্যাং আউট আর নতুন পোশাকের প্রদর্শনী। আর বিপুর ওয়ালে ছিলো একটি মাত্র ছবি যাতে দেখা যাচ্ছিলো ১০ দু-গুণে ২০টি টুকটুকে লাল পাঞ্জাবি আর ফ্রক পরিহিত ২০ জন ছিন্নমূল শিশু। যাদের মুখে শোভা পাচ্ছিলো গাল ভর্তি ঈদের চাঁদের হাসি। তার ফাঁকে বিপু-মুহিতের ফিকে যাওয়া পাঞ্জাবিগুলো ঢেকে দিয়েছিলো স্রষ্টা নিজ হাতে। আর সেই ছবিটিতে একটি মাত্র 'লাভ রিয়েক্ট' ছিলো মৌমিতার। কমেন্টে লিখা ছিলো 'ভালোবাসি'।
Comments
Post a Comment